দেশ কন্ঠ রিপোর্ট
- ২৪ আগস্ট, ২০২০ / ৬৭২ বার পঠিত
আমাদের বাড়িটা অনেক বড় ও বেশ পুরনো। বাড়ির সামনেই একটা কবর । শ্যাওলা পরে পরে বলতে গেলে ইটগুলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। কবরের উপর একটা কড়াই গাছ আর একটা আমড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে। যেন পাহারা দিচ্ছে কবরটাকে। যদিও এ গাছের আমড়া কোনদিন খেতে দেওয়া হয় নি কাউকে।কারণ জিজ্ঞাসা করলেই সবাই চুপ হয়ে থাকে। বলতে গেলে ছোটবেলা থেকেই আমাদের সকলের কৌতুহল ঐই কবরটাকে ঘিরে।আমরা যৌথ পরিবার। আমার বাবারা পাঁচ ভাই এক বোন।বড় চাচা ও মেজ চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।বড় চাচা চলে গেলেন গত বর্ষায়।মেজ চাচা কয়েক বছর আগেই ।বাকি তিন জনের মধ্যে তিন জনেই শিক্ষক ছিলেন। এখন বাবা ছাড়া বাকি দুজন অবসরে। আমার বাবা,মাতিন চাচা আর হেলাল চাচা। তাঁদের মধ্যে মাতিন চাচা আমাদের সকলের প্রিয় মানুষ। আমাদের চাচাতো ভাই বোনদের সাথে একধরনের ভালোই সখ্যতা ছিল মাতিন চাচার। আমরা প্রায় সেই কবরটাকে নিয়ে প্রশ্ন করতাম চাচাকে। কিন্তু তিনি বলতেন ,”তোরা যেদিন বড় হবি , আমি সেদিন নিজে থেকেই বলব তোদের এই কবর সম্পর্কে।” তবে এখন আমরা সবাই বড় হয়ে গেছি। চাচাতো ভাই বোনদের মধ্যে আমি সকলের ছোট। প্রায় সবার বিয়ে হয়েছে কিন্তু আমি আর তিরু আপা বাদে। সামনে তিরু আপার বিয়ে বলে আমরা আবার সবাই একত্রিত হয়েছি গ্রামের বাড়িতে। এবার সবাই ঠিক করলাম মাতিন চাচার কাছে গল্প শুনব সেই কবরটা নিয়ে।সবার আগ্রহের যেন শেষ নেই! আমরা সবাই প্লান করলাম আজ রাতেই চাচার কাছে সেই গল্প শুনব।রাতে সবাই চাচার কাছে গেলাম।বাড়ির পাশেই বড় পুকুরটার শাণে বসে সিগারেট টানছেন চাচা। আমাদের দূর থেকে দেখা মাত্র সিগারেটটা দূরে ফেলে দিলেন। হেসে হেসে বললেন,
—–কি ব্যাপার, সবাই কি দল হয়ে বেড়াচ্ছিস নাকি?
অরু আপা বললো,”না চাচা, আমরা সবাই তোমাকে খুঁজছি।আজ তোমার কাছে গল্প না শুনে তোমায় ছাড়ছি না”
সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠলো!
চাচা হেসে হেসে বললেন,”কি গল্প শুনবি বল? ভূতের গল্প শুনবি নাকি?চল তোদের একটা ভূতের গল্প শোনাই।”
মাসুক ভাই বলল,”না চাচা,আজ আমরা সেই গল্প শুনব, আমাদের কৌতুহূল এ থাকা সেই কবরের গল্প, যে গল্প শোনার জন্য আমাদের এত বড় হতে হয়েছে। চাচা প্লিজ,আজ আমাদের না করিও না।”
চাচা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,”ঠিক আছে তবে তাই হবে। আমারও মাঝে মাঝে মনে হয় তোদের এই গল্পটা শোনা উচিত। কোন এক বিচিত্র কারণে তোদের সেই গল্প বলতে চেয়েও বলা হয়ে উঠে না।”
পরিবেশ টা মুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল!সবার দৃষ্টি চাচার দিকে। কবরটাকে নিয়ে সবার যে কৌতুহল ছিল আজ সেই কৌতুহলের অবসান হতে যাচ্ছে।
চাচা শুরু করলেন,
———তোরা তো জানিস আমাদের একটা বোন ছিল। তোদের ফুফুজান। আমাদের বংশের একমাত্র মেয়ে। বাবার ভীষণ আদরের ছিল। দেখতে খুবই রুপবতী ছিল, বলতে গেলে দুধে আলতা গায়ের রং। দেখতে পরীর মতো সুন্দর ছিল বলে বাবা ওর নাম রেখেছিল পরীবানু।পরীবানু ভীষণ আদরের ছিল বটে কিন্তু তার সমস্ত সুখ সেদিন ই নষ্ট হয়ে যায় যেদিন তার বিয়ে হয়। বাবা দেওয়ান ঘটকের কথা শুনে রসুলপুরের খাঁনবাড়ীর এনায়েত খাঁ র ছেলে মাজেদ খাঁ এর সাথে বিয়ে দেন তোদের ফুফুর।
খাঁন বাড়ি সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না আমরা। বাবা না জেনেই দেওয়ান ঘটকের কথা শুনেই বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন । কিন্তু কে জানত মাজেদ খাঁন ছিল ভীষণ লোভী আর অত্যাচারী। শুনেছিলাম প্রায় দিনই সে মারধর করত তোদের ফুফুকে। এমনকি তার শ্বাশুড়িও খুব জ্বালাতন করত তাকে। নির্যাতন আরো বেড়ে যেতে থাকে যখন বিয়ের সাত বছর পরেও তার কোলে কোন সন্তান না আসায়। এরপর দেশে শুরু হয় যুদ্ধ।১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ শুরু হলে খাঁন বাড়িতে পাকিস্তানের ফ্লাগ উঠানো হয়। মাজেদ খাঁ ছিল শান্তি বাহিনীর চেয়ারম্যান। এদিকে আবার তোদের বড় চাচা আর মেজ চাচা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। মাজেদ খাঁ এর মধ্যে আবারো বিয়ে করার ফন্দি আঁটেন। এদিকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হওয়ায় আমাদের ওপরেও পাকিস্তানিদের অত্যাচার শুরু হতে থাকে। কিন্তু তোদের ফুফুর পীড়াপীড়িতে মাজেদ খাঁর অনুরোধে পাকিস্তানি সেনাদের আমাদের উপর অত্যাচার কিছুটা কমে। কিন্তু বিশ্বাস কর বাবা মাজেদ খাঁর পরিচয় কোনদিনই দেননি। বাবা তাকে ঘৃণা করতেন দেশের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতার জন্য। বাবা সবসময় গর্ব করতেন তাঁর দুই ছেলে মুক্তিযোদ্ধা বলে। মাজেদ খাঁর অনুরোধের আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলেছিল। শেষে একটা চালা উঠিয়ে অনেক কষ্টে মুক্তিযুদ্ধের সময়টা পার করেছি আমরা। এদিকে মাজেদ খাঁ আবারও নতুন বিয়ে করে। পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প করেছিল মাজেদ খাঁর বাড়ির পাশেই প্রাইমারি স্কুলটাতে। একদিন পাকিস্তানি সেনাদের নিজের বাড়িতে দাওয়াত দেয় মাজেদ খাঁ। শুনেছিলাম গ্রামের যুবতী মেয়েদেরকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দিতেন মাজেদ খাঁ। পাকিস্তানি কমান্ডার ইরফাজ আহমেদ সেবার তোদের ফুফুকে দেখে তার ভালো লাগার কথা বলেছিল।বলেছিল তোদের ফুফুকে সে বিবাহ করতে চায়। মাজেদ নাকি বলেছিল ,”হুজুর আপনি যা চাইবেন তাই হবে। আপনি চাইলে আমি বড় বিবিকে তালাক দিয়ে আপনার সাথে নিকাহ এর ব্যাবস্থা করতে পারি।” এদিকে তোদের ফুফুকে তালাক দিয়ে তোর ফুফুকে জোর করে আটকে রাখে মাজেদ খাঁ। তোর ফুফুর পেটে মাজেদ খাঁর সন্তান এ কথা বলার আগেই তাকে তালাক দেয় মাজেদ খাঁ।ভয়ে তাই আর পরে সে কথা বলেনি মাজেদ খাঁকে। বাচ্চা নষ্ট করে দিতে পারে মাজেদ খাঁ তাই। অনেক জোর করে রাজি না হওয়া সত্ত্বেও ইরফাজ আহমেদ এর সাথে তোর ফুফুর বিয়ে দেন মাজেদ খাঁ, তার নিজ বাড়িতেই।ইরফাজ আহমেদ কে বাসর রাতে সব কথা খুলে বলেছিল তোর ফুফু । কিন্তু ইরফাজ আহমেদ এককথার মানুষ তিনি বাচ্চা নষ্ট করার জন্য বললেন। তিনি যা বলেন তাই করতে হবে। টেবিলে রিভলবার ,আলনায় কাপড় রেখে রাগান্বিত হয়েই সে রাতে শুয়ে পড়েছিল ইরফাজ আহমেদ। যখন সে গভীর ঘুমে অচেতন তখন রিভলবার হাতে নিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় ইরফাজ আহমেদ কে গুলি করে তোর ফুফু। গুলির শব্দ শুনেই পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে দরজায় কড়া নাড়তে থাকে মাজেদ, সে মনে করেছিল হয়ত ইরফাজ আহমেদ পরীবানুকে গুলি করেছে কিন্তু দরজা খুলে মাজেদের বুকেও গুলি চালিয়ে দেয় পরী। তৎক্ষণাৎ সে পালিয়ে যেতে চাইলে পিছন থেকে তার উপর অঝোরে গুলি চালাতে থাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীরা। ছিন্ন -বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার শরীর। শুধু নিজের পেটের সন্তানকে বাঁচানোর জন্যই সে এমনটা করেছিল। যুদ্ধ শেষে আমরা সব জানতে পারি। বাবাও অনেকটা পাগলের মতো হয়ে যায় কন্যা শোকে। তাঁর আদরের মেয়েকে শেষ দেখাও দেখতে পারেননি তিনি। আমাদের উঠোনে নিজেই কবর খুঁড়ে পরী আপার পুরনো কিছু কাপড় ওর বই, চুড়ি,ছোটবেলার খেলনা পাতি কবর দেন তিনি। শোকে তিনিও আর বেশি দিন বাঁচেন নি। যাওয়ার আগে বাবা বলে গিয়েছিলেন ঐই কবরটা যেন কেউ ভেঙে না ফেলে। কিন্তু ওটা আসলে কবর না আমার বাবার তাঁর মেয়ের কবর দেয়া কিছু স্মৃতি।তাই আমরা বাবার কথায় আর কোনদিন ভেঙে ফেলিনি কবরটা । আমাদের কাছেও আজ ও কবর হয়ে আছে সেই কবরটা।থাক না আমাদের বুবুর কবর।
চশমা খুলে চোখের কোনে থাকা জল মুছলেন চাচা। আমাদের সকলের চোখে জল। চাচা আমাকে বললেন,” তপু ,আমাকে একটু ঘরে নিয়ে যা তো। “আমি চাচার হাত ধরে তাঁকে ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।আর চাচা মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছেন কবরটার দিকে।
লেখক
শাহরিয়ার কবির রাহাত
শিক্ষার্থী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।